ভারতের সবুজ বিপ্লবের জনক
আমদের দেশ ভারত, প্রাচীন কাল থেকে ভারতে কৃষিকাজ হয়ে এসেছে। আর এই কৃষি কাজের উপরে নির্ভর করে ভারত বিভিন্ন দেশের সাথে বাণিজ্য করেছে। এবং এই কারণে বিদেশী শত্রুরা আমাদের দেশে আক্রমণ করেছিলো। যাইহোক দীর্ঘ দুশো বছর পরাধীন থাকার পর ভারত যখন স্বাধীন হয় তখন, আমাদের দেশের কৃষি ব্যবস্থা এত ভালো ছিলো না, যা আমরা আগে দেখতে পাই।
সবুজ বিপ্লবের সূত্রপাত
তখন আমাদের দেশের খাদ্যশস্যের চাহিদা মেটানোর জন্য বিদেশের উপর নির্ভর থাকতে হতো। আর এই নির্ভর শীলতা কাটিয়ে তোলার জন্য ভারতে এক বিপ্লব শুরু হয়, যা সবুজ বিপ্লব নামে পরিচিত। আর এই বিপ্লব কে সফল করতে যার অবদান রয়েছে তিনি হলেন " এমএস স্বামীনাথন"(মানকম্বু সাম্বাসিভান স্বামীনাথন)
মানকম্বু সাম্বাসিভান স্বামীনাথন |
এমএস স্বামীনাথন জীবনী
৭ আগষ্ট ১৯২৫ সালে তামিলনাড়ুর কুম্বাকোনামে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। ছোটো বেলা থেকে স্বামীনাথনের কৃষির প্রতি আগ্রহ ছিলো। তিনি একটি স্থানীয় উচ্চ বিদ্যালয়ে এবং পরে কুম্বাকোনামের ক্যাথলিক লিটল ফ্লাওয়ার হাই স্কুলে শিক্ষিত হন, যেখান থেকে তিনি পনেরো বছর বয়সে ম্যাট্রিকুলেশন করেন। তার পরিবার চাল, আম এবং নারকেল চাষ করত এবং পরে কফির বাগানো তৈরি করেছিলো। তিনি দেখেছিলেন ফসলের দামের ওঠানামা তার পরিবারের উপর প্রভাব ফেলেছিল, যার মধ্যে আবহাওয়া এবং কীটপতঙ্গ ফসলের পাশাপাশি আয়েরও ক্ষতি করতে পারে।
স্বামীনাথনের জীবনী
তার বাবা-মা চেয়েছিলেন সে ডাক্তারি পড়ুক। সে কথা মাথায় রেখে তিনি প্রাণিবিদ্যা নিয়ে উচ্চশিক্ষা শুরু করেন। কিন্তু যখন তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় উনিশ্য তেতাল্লিশ সালের বাংলার দুর্ভিক্ষ এবং সমগ্র উপমহাদেশে চালের অভাবের প্রভাব প্রত্যক্ষ করেন , তখন তিনি ভারতে পর্যাপ্ত খাদ্য নিশ্চিত করার জন্য তার জীবন উৎসর্গ করার সিদ্ধান্ত নেন।পরিবারে সকলের বোঝানো সত্ত্বেও, এবং এমন এক সময়ে যেখানে চিকিৎসা ও প্রকৌশলকে অনেক বেশি মর্যাদাপূর্ণ বলে মনে করা হত, সেখানে তিনি কৃষিকে বেছে নিয়েছিলেন।
উচ্চ শিক্ষা অর্জন
তিনি কেরালার ত্রিভান্দ্রামের মহারাজা কলেজে প্রাণীবিদ্যা স্নাতক ডিগ্রি শেষ করেন এবং তার পরে উনিশ্য চল্লিশ থেকে উনিশ্য চয়াল্লিশ সালের মধ্যে তিনি মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে কৃষি বিদ্যা নিয়ে অধ্যয়ন করে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
১৯৪৭ সালে তিনি জেনেটিক্স এবং উদ্ভিদ প্রজনন অধ্যয়নের জন্য নয়াদিল্লিতে ভারতীয় কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটে চলে যান । এই বছর তিনি সালে সাইটোজেনেটিক্সে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন।১৯৫০ সালে, তিনি ইউনিভার্সিটি অফ কেমব্রিজ স্কুল অফ এগ্রিকালচারের প্ল্যান্ট ব্রিডিং ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করতে চলে যান । তিনি উনিশ্য বাহান্ন সালে তার থিসিসের জন্য ডক্টর অফ ফিলোসফি ডিগ্রি অর্জন করেন ।
গবেষণার মুহূর্ত
স্বামীনাথন তখন পোনেরো মাস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কাটিয়েছিলেন। তিনি ইউএসডিএ আলু গবেষণা কেন্দ্র স্থাপনে সাহায্য করার জন্য উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যাবরেটরি অফ জেনেটিক্স -এ পোস্ট-ডক্টরাল রিসার্চ অ্যাসোসিয়েটশিপ গ্রহণ করেন।
স্বামীনাথনের ভারতে ফেরা
স্বামীনাথন ১৯৫৪ সালের শুরুর দিকে ভারতে ফিরে আসেন। তার বিশেষীকরণে কোন চাকরি ছিল না এবং মাত্র তিন মাস পরে তিনি একজন প্রাক্তন অধ্যাপকের মাধ্যমে কটকের সেন্ট্রাল রাইস রিসার্চ ইনস্টিটিউটে সহকারী উদ্ভিদবিদ হিসাবে অস্থায়ীভাবে কাজ করার সুযোগ পান । কটকে, তিনি কৃষ্ণস্বামী রামিয়া দ্বারা শুরু করা একটি ইন্ডিকা-জাপোনিকা ধানের সংকরকরণ কর্মসূচির অধীনে ছিলেন । এই কাজটি গমের সাথে তার ভবিষ্যতের কাজকে প্রভাবিত করবে। পরে তিনি ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে নয়াদিল্লিতে ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটে একজন সহকারী সাইটোজেনেটিস্ট হিসেবে যোগ দেন।স্বামীনাথন ভারতের খাদ্যশস্য আমদানির সমালোচনা করেছিলেন যখন ভারতের সত্তর শতাংশ কৃষির উপর নির্ভরশীল ছিল। দেশে আরও খরা ও দুর্ভিক্ষের মতো পরিস্থিতি তৈরি হতে থাকে।
সহযোগিতা
সেই সময়ে আমেরিকার কৃষিবীদ নর্মান বোরলাগ ভারত সফর করেছিলেন এবং স্বামীনাথন কে মেক্সিকান বামন জাতের গমের জন্য বীজ সরবরাহ করেছিলেন। যেগুলি জাপানি জাতের সাথে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রজনন করা হয়েছিলো এবং তার ভালো ফলাফল ও দেখা গেছিলো। ফসলটি ছিল উচ্চ ফলন, ভালো মানের এবং রোগমুক্ত। 1964 সালে, নতুন জাতটি প্রদর্শনের জন্য স্বামীনাথনের বারবার অনুরোধের পর, তাকে ছোট প্রদর্শনী প্লট রোপণের জন্য তহবিল দেওয়া হয়েছিল। 1 হেক্টরে মোট 150টি প্রদর্শনী প্লট রোপণ করা হয়েছিল। ফলাফল আশাব্যঞ্জক ছিল এবং কৃষকদের নতুন বীজের প্রতি যে উদ্বেগ ছিলো তা কমে গিয়েছিল। ভারতীয় অবস্থার সাথে মানানসই করার জন্য পরীক্ষাগারে শস্যে আরও পরিবর্তন করা হয়েছিল। নতুন গমের জাত বপন করা হয় এবং 1968 সালে উৎপাদন 17 মিলিয়ন টন হয়, যা শেষ ফসলের চেয়ে 5 মিলিয়ন টন বেশি।
প্রাপ্ত পুরস্কার
ওনার এই কাজের জন্য উনিশ্য সত্তর সালে তিনি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত হোন। এই বছর ভারত সরকার ভারতকে খাদ্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ ঘোষণা করে। যদি বর্তমান পরিস্থিতি দেখি, তাহলে দেখতে পাবো যে ভারত খাদ্যশস্যের মধ্যে ধান উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে, গম উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে এবং অন্যান্য শস্য উৎপাদনে প্রথম থেকে চতুর্থ স্থানে বিরাজ করে।
ওনার এই অবদানের জন্য তিনি অনেক পুরস্কার পেয়ে ছিলেন।
• পদ্মশ্রী (১৯৬৭)
• র্যামন ম্যাগসেসে পুরস্কার (১৯৭১)
• পদ্মভূষণ (১৯৭২)
• বিশ্ব খাদ্য পুরস্কার (১৯৮৭)
• পদ্মবিভূষণ (উনিশ্য উননব্বই)
শেষ মুহূর্ত
এর পর দীর্ঘ বছর বয়েস জনিত কারণে অসুস্থ থাকার পর আঠাশে সেপ্টেম্বর দুই হাজার তেইশ সালে তিনি মারা যান। আমরা ভারতবাসি চিরকাল ওনার এই অবদানের জন্য তাকে স্মরণ করব।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন